Saturday, December 13, 2014

এ মনের ভাব একদিনে হয় নাই। কত রূপে কত সাজেই যে বন্যপ্রকৃতি আমার মুগ্ধ অনভ্যস্ত দৃষ্টির সম্মুখে আসিয়া ভুলাইল! - কত সন্ধ্যা আসিল অপূর্ব রক্তমেঘের মুকুট মাথা, দুপুরের খরতর রৌদ্র আসিল উন্মাদিনী ভৈরবীর বেশে, গভীর নিশীথের জ্যোৎস্নাবরনী সুরসুন্দরীর সাজে হিমস্নিগ্ধ বনকুসুমের সুবাস মাখিয়া, আকাশভরা তারার মালা গলায় - অন্ধকার রজনীতে কালপুরুষের আগুনের খড়গ হাতে দিগ্বিদিক ব্যাপিয়া বিরাট কালীমূর্তিতে। (১৬)


আমি পাকুড় গাছের ঘন ছায়ায় দাঁড়াইয়া যখন যখন জয়পালের সঙ্গে কথা বলিতাম, তখন আমার মনে এই সুবৃহৎ বৃক্ষতলের নিবিড় শান্তি ও গৃহস্বামীর অনুদ্বিগ্ন নিস্পিহ ধীর জীবনযাত্রা ধীরে ধীরে কেমন একটা প্রভাব বিস্তার করিত। ছুটোছুটি করিয়া বেড়াইয়া লাভ কি? কি সুন্দর ছায়া এই শ্যাম-বংশী বটের, কেমন মন্থর যমুনাজল, অতীতের শত শতাব্দী পায়ে পায়ে পার হইয়া সময়ের উজানে চলিয়া যাওয়া কি আরামের! (৩৩)        


যাক না ঘোড়া আস্তে বা জোরে, শৈলসানুতে যতক্ষণ প্রথম বসন্তে প্রস্ফুটিত রাঙা পলাশ ফুলের মেলা বসিয়াছে, পাহাড়ের নীচে, উপরে, মাঠের সর্বত্র ঝুপসি গাছের ডাল ঝাড় ঝাড় ধাতুপফুলের ভারে অবনত, গোলগোলি ফুলের নিষ্পত্র দুগ্ধশুভ্র কাণ্ডে হলুদ রঙের বড় বড় সূর্যমুখী ফুলের মত ফুল মধ্যাহ্নের রৌদ্রকে মৃদু সুগন্ধে অলস করিয়া তুলিয়াছে - তখন কতটা পথ চলিল, কে রাখে তাহার হিসাব? (৩৭)


জ্যোৎস্না আরো ফুটিয়াছে, নক্ষত্রদল জ্যোৎস্নালোকে প্রায় অদৃশ্য, চারিধারে চাহিয়া মনে হয় এ সে পৃথিবী নয় এতদিন যাহাকে জানিতাম, এ স্বপ্নভূমি, এ দিগন্তব্যাপী জ্যোৎস্নায় অপার্থিব জীবেরা এখানে নামে গভীর রাত্রে, তারা তপস্যার বস্তু, কল্পনা ও স্বপ্নের বস্তু, বনের ফুল যারা ভালবাসে না, সুন্দরকে চেনে না, দিগ্বলয়রেখা যাদের কখনও হাতছানি দিয়া ডাকে নাই, তাদের কাছে এ পৃথিবী ধরা দেই না কোন কালেই। (৪৩)  


কিন্তু অনন্যমনা হইয়া প্রকৃতিকে লইয়া ডুবিয়া থাক, তাঁর সর্ববিধ আনন্দের বর, সৌন্দর্যের বর, অপূর্ব শান্তির বর তোমার উপর অজস্রধারে এত বর্ষিত হইবে, তুমি দেখিয়া পাগল হইয়া উঠিবে, দিনরাত প্রকৃতিরানী তোমাকে শতরূপে মুগ্ধ করিবেন, নুতন দৃষ্টিতে জাগ্রত করিয়া তুলিবেন, মনের আয়ু বাড়াইয়া দিবেন, অমরলোকের আভাসে অমরত্বের প্রান্তে উপনীত করাইবেন। (৬৪)

জনশূন্য বিশাল লবটুলিয়া বইহারের দিগন্তব্যাপী দীর্ঘ বনঝাউ ও কাশের বনে নিস্তব্ধ অপরাহ্নে একা ঘরার উপর বসিয়া এখানকার প্রকৃতির এই রূপ আমার মনকে অসীম রহস্যানুভূতিতে আছন্ন করিয়া দিয়াছে, কখনও তাহা আসিয়াছে ভয়ের রূপে, কখনও আসিয়াছে এক নিস্পহ, উদাস, গম্ভীর মনোভাবের রূপে, কখনও আসিয়াছে কত মধুময় স্বপ্ন, দেশবিদেশের নরনারীর বেদনার রূপে। সে যেন খুব উচ্চদরের নীরব সঙ্গীত - নক্ষত্রের ক্ষীণ আলোর তালে, জ্যোৎস্নারাতের অবাস্তবতায়, ঝিল্লীর তানে, ধাবমান উল্কার অগ্নিপুচ্ছের জ্যোতিতে তার লয়-সঙ্গতি। (৬৫)


আর কী সে জ্যোৎস্না! কৃষ্ণপক্ষের স্তিমিতালোক চন্দ্রের জ্যোৎস্না বনে-পাহাড়ে যেন একশান্ত, স্নিগ্ধ, অথচ এক আশ্চর্য রূপে অপরিচিত স্বপ্নজগতের রচনা করিয়াছে - সেই খাটো খাটো কাশ-জঙ্গল, সেই পাহাড়ের সানুদেশে পীতবর্ণ গোলগোলি ফুল, সেই উঁচুনিচু পথ - সব মিলিয়া যেন কোন বহুদুরের নক্ষত্রলোক - মৃত্যুর পরে অজানা কোন অদৃশ্য লোকে অশরীরী হইয়া উড়িয়া চলিয়াছি - ভগবান বুদ্ধের সেই নির্বাণলোকে, যেখানে চন্দ্রের উদয় হয় না, অথচ অন্ধকারও নাই। (৬৭)


চারিধার নীরব নিস্তব্ধ -পূর্ব তীরের ঘন বনে কেবল শৃগালের ডাক শোনা যাইতেছিল - দুরের শৈলমালা ও বনশীর্ষ অস্পস্ত দেখাইতেছে - জ্যোতস্নার হিমবাতাসে গাছপালা ও ভোমরা লতার নৈশপুষ্পের মৃদু সুবাস ... আমার সামনে বন ও পাহাড়ে বেষ্টিত নিস্তরঙ্গ বিস্তীর্ণ হ্রদের বুকে হৈমন্তী পূর্ণিমার থৈ থৈ জ্যোৎস্না ... পরিপূর্ণ, ছায়াহীন, জলের উপর পড়া, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বীচিমালায় প্রতিফলিত হওয়া অপার্থিব দেবলোকের জ্যোৎস্না ... ভোমরা লতার সাদা-ফুলে-ছাওয়া বড় বড় বনস্পতিশীর্ষে জ্যোৎস্না পড়িয়া মনে হইতেছে গাছে গাছে পরিদের শুভ্র বস্ত্র উড়িতেছে ... (৭৩)

       
_____________
প্রস্তাবনা - অষ্টম

No comments:

Post a Comment

Your Thoughts ...