মানবসমাজ, আমাদের ঐতিহ্য, ছবি করা ও আমার প্রচেষ্টা
ঋত্বিক ঘটক
সব শিল্পকর্মেই বিভিন্ন স্তরে রস সঞ্চারিত হয়ে থাকে। রসের অধিকারী ভেদে বিভিন্ন স্তর থেকে মানুষ রস গ্রহণ করে থাকে।
যেমন ধরুন ছবিতে। প্রাথমিক স্তরে একটা টানা গল্প হয়তো থাকে-হাসি-কান্না,
সুখ-দুঃখ দিয়ে বিচিত্র জীবনের নকশা আঁকা থাকে। একটু গভীর স্তরে প্রবেশ করলে
দেখা যায় রাজনৈতিক, সামাজিক দ্যোতনাগুলি খেলা করছে। আরও গভীরে প্রবেশ করে
যার মন, তিনি দেখেন দর্শনগত ও শিল্পীর আত্মচেতনা অনুসারে দিগ্নির্দেশগত
সংকেতগুলি। তারও একেবারে গভীরে তলিয়ে যিনি যান, তিনি যে মুহূর্তগত অনুভুতির
আস্বাদন লাভ করেন, তাকে কথা দিয়ে ধরা যায় না। সেই মুহূর্তগুলিতে তিনি
অজ্ঞেও কিছু একটার দোরগোড়ায় গিয়ে উপস্থিত হন।
এই সব ক’টি স্তরের রস
আস্বাদন করা সকলের পক্ষে সমানভাবে সম্ভরপর নয়, এবং সেটা আশাও করা যায় না।
যার যে স্তরে বিচরণ, তিনি সেই স্তরেই আনন্দ পাবেন, এটাই কাম্য। কিন্তু
সত্যিকারের মহৎ শিল্প এর সব কটা স্তরকেই ছুঁয়ে যায়, এটা হচ্ছে মহৎ শিল্পের
প্রাথমিক শর্ত।
এইখানটিতে পুজো-আচার সঙ্গে ব্যাপারটির বেজায় মিল। এর
প্রাথমিক স্তরে আছে সাংসারিক দেবতার সঙ্গে লেনদেনের কারবার, একেবারে গভীরে
গিয়ে সেই অনিবর্চনীয়।
এই যে গভীরতম দিকটি, এর স্বরূপ বুঝতে comparative mythology আমাদের প্রচুর সাহায্য করে। শুধু সিনেমায় নয়, সর্বকালের সব শিল্পেই।
আমরা নব মনস্তাত্ত্বিকদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও গবেষণা থেকে শিল্প-বিচারের
কতগুলি মূল সূত্র পাই, যাকে comparative mythology আমাদের সামনে illustrate
করে।
যেমন ধরুন archetype ব্যাপারটি। মানুষের পরিপূর্ণ মানুষ হয়ে ওঠার
আগের থেকেই বিধৃত হয়ে আছে social collective unconscious- অর্থাৎ
মানবজাতির যৌথ অবচেতন স্মৃতির ভাণ্ডার। মানুষের যা কিছু গভীরতম অনুভূতি,
সবেরই উৎস এখানে। এবং কিছু কিছু মৌল-প্রতীক (archetype) মানুষের বিভিন্ন
ঘটনার প্রতি যে প্রতিক্রিয়া, তাকে নিয়ন্ত্রিত করে থাকে। স্বতস্ফূর্ত
মানুষের যে প্রতিক্রিয়া তার বেশিরভাগেরই মূল এইখানে। এবং এই archetype সব
সময়ই image-এর মধ্য দিয়ে symbol হয়ে দেখা দেয়। কথাটা খুবই জটিল এবং এর
ব্যাখ্যা আমার পক্ষে সম্পূর্ণভাবে দেওয়া সম্ভব নয়, বিশেষ করে এত ছোট
নিবন্ধের মধ্যে।
তবে কিছু উধাহরণ দিলে হয়তো ব্যাপারটা খানিকটা
পরিষ্কার হবে। মানুষের যে-কোনো সমাজের যেকোন মূল্য আরোপকেই দেখানো যায় শেষ
অবধি এই mythical values-এর প্রকাশরূপে। যেমন ধরুন, পোলিনেশিয়ার কোন-কোন
দ্বীপের অধিবাসীদের barter হচ্ছে ( অর্থাৎ টাকার বদলে যা ব্যবহৃত হয়)
শূয়োর। তার কারণ, তাদের পৌরাণিক উপকথাতেই শূয়োর হচ্ছে সবচেয়ে পবিত্র জন্তু।
কারণ, পৌরানিক উপকথাগত বিচিত্র কার্যকারণ পরম্পরা-অনুসারে ওদের কাছে শূয়োর
হচ্ছে এই পৃথিবীতে চন্দ্রের প্রতীক। এবং চাঁদ হচ্ছে ওদের সমস্ত
জীবনযাত্রার খুঁটি।
এটা শুনতে যতটা আজগুবি লাগছে, ব্যাপারটা কিন্তু
ততটা আজগুবি নয়। শূয়োর থেকে সোনার কি কোন বেশি মূল্য আছে? সোনা ধাতু
হিসেবে বিশেষ কোনো কাজেরই নয়। একমাত্র তার টেকবার ক্ষমতা খুব বেশি। কিন্তু
ওর থেকেও durable ধাতু এবং ওর থেকেও বেশি সহজপ্রাপ্য ধাতু আছে।
কিন্তু
সোনা যে ইউরোপ ও এশিয়ার বিভিন্ন সভ্যতাতে এই স্থান অধিকার করেছে তার কারণ
পৌরাণিক উপকথাগতভাবে সোনা হচ্ছে সূর্যের প্রতীক। এবং সূর্য সভ্যতাগুলির
প্রাণকেন্দ্রস্বরূপ।
Mythology সম্পর্কে কিছু ব্যাখ্যা এই সুযোগে করে রাখছি।
`Myth- and therefore civilization – is a poetic, super-normal image,
conceived, like all poetry, in depth, but susceptible of interpretation
on various level. The shallowest minds see in it the local scenery , the
deepest the freground of the void…’ ( The masks of god: Joseph
campbell).
এবং এই mythology দেখায় যে সমস্ত সভ্যতার ইতিহাস দুই
রকম। মানবচেতনার সংঘর্ষের উতিহাস। এক হচ্ছে কর্মযোগ্যদের চেতনা, আর এক
ভাবুকদের চেতনা। এই ভাবুকই কবি, শিল্পী, shaman, medicine-man, ঋষি এবং
মন্ত্রদ্রষ্টা।
`The Two types of minds, thus, are complementary, the
tongh-minded, representing the insert, reactionary ; and the
tender-minded, the living progressive impulse – respectively attachment
to the local and timely and the impulse to the timeless universal.’
এই tender-minded রাই অশান্ত-চঞ্চল এবং এদের মধ্যেই archetype
দ্যুতিময়ভাবে খেলা করতে থাকে। অর্থাৎ প্রকাশমান হয়। যেসন ধরুন না- এই
archetype-টি; প্রথম মানুষের যে শিল্পকলার নিদর্শন আমরা পাই তা হচ্ছে
প্যালিওলিথিক যুগের স্পেন ও ফ্রান্সের মধ্যবর্তী পিরেনীজ পর্বতমালার গভীর
গুহাগুলিতে নগ্ন মাতৃকামূর্তি। এবং এই A Great Mother সারা পৃথিবীর বিভিন্ন
জাতির চেতনায় আজও haunt করছে। এর দুই রূপ- এক হচ্ছে বরাভয় Sophia আর এক
হচ্ছে ত্রাসদাত্রী কালী, চণ্ডীর রূপ। আমাদের পূরাণে এ দুদেবীকে একত্রে দুই
রূপেই কল্পনা করা হয়েছে, “দেবীযুক্ত”। এবং আমাদের সমাজের মজ্জায় মজ্জায়
ঢুকে আছে এই মাতৃভাবরূপী archetype টি।
বাংলাদেশের সমস্ত আগমনী বিজয়ার গান, লোককথার সমস্ত গভীর দিকগুলি এই সাক্ষ্যই বহন করছে।
এই ভুমিকাটুকুর দরকার ছিলো এই জন্য যে, ছবি করার পদ্ধতিতে এই গোটা
ব্যপারটা ভীষণভাবে এসে পড়ে। এবং এটা হচ্ছে ছবির সর্বভারতীয় স্তর, যার
মানবিক নিক্তিতে কোন ছবির চূড়ান্ত বিচার করতে হবে। সব শিল্পেই অতীতে
এ-বিচার জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে হয়ে গেছে এবং কালের ঘরে সেই শিল্পই টিকে
গেছে যা এই বিচারে পার পেয়েছে। শেক্সপিয়ার সাহেবকে নিয়ে ওদেশের প-িতেরা এখন
দেখিয়ে দিচ্ছেন যে সভ্যতার যেকোন স্তরের মহৎ শিল্পীর কাজের মধ্যে কত বড়ো
স্থান এই অনির্বচনীয় ব্যাপারটি অধিকার করে আছে।
Dolce Vita-র
চূড়ান্ত সাফল্য কোথায়? Roman Catholic Culture Complex-এর জড় ধরে নাড়া দিতে
গিয়ে Fellini বারেবারেই Primordial archetype-এর সম্মুখিন হয়েছেন। তারা
যেমন সহজে এসেছে, তেমনি গেছে। কিন্তু মনের গভীরকে একবার নাড়া দিয়ে গেছে।
এবং তার রেশের অনুরণন চলেছে অনেককাল ধরে মনের মধ্যে। “পথের পাঁচালী”র
ইন্দির ঠাকুরণ সিকোয়েন্সে দু-একটি যায়গায় বুড়ি গ্রামবাংলার আত্মারূপে
প্রতিভাত হতে পেরেছিলো, কারণ তার ইমেজের মধ্যেই এই force জন্মগ্রহণ
করেছিলো। এই জন্যই ইন্দির টাকুরণকে কোনোদিন ভোলা সম্বব নয়।
নাজারিন-এ ঐ archetypal oftinerant priest এক একটা stature গ্রহণ করেছিলো যেখানে তাকে আর এক যীশুখ্রিস্ট বলে মনে হয়েছিলো।
এইরকম উদাহরণ আরো দেওয়া যায়। যেমন, চ্যাপলিন সাহেব। তিনি মূর্তিমান
mythology তিনি কোন দেশের নাগরিক নন। তাঁর দুর্বল নিষ্পষিত অসহায় চেহারার
মধ্যে সমস্ত জীবনের নির্যাসটুকু ভরে রয়েছে। মানুষের সভ্যতা যেদিন সভ্যতা
হলো, অর্থাৎ যেদিন শ্রেণির জন্ম হল – সেইদিন থেকে আজ পর্যন্ত শ্রেণীসমাজের
সমস্ত ব্যথার, সমস্ত বঞ্চণার প্রতিভূ হচ্ছে ঐ ছোট্টখাট্ট মানুষটি।
আমার ছবিতেও আমি এই কথাগুরি মনে রাখার চেষ্টা করেছি। আমাদের জাতীয় culture
complex যেভাবে constellate করেছে তার গভীরে অনুপ্রবেশ করার চেষ্টা আমার সব
ছবিতেই করেছি, যার ফলে হয়তো সবসময় সহজবোধ্য থাকতে পারিনি, শুধু ওদেশ নয় ,
এদেশেও। তার কারন আমার অক্ষমতা ছাড়াও আরেকটা জিনিস আছে। সেটা হচ্ছে-আমাদের
দেশ-বিশেষ করে তার মুখর অংশ-খুব সহজেই এ যুগে শেকড় হারিয়েছে। এটা একটা
অত্যন্ত তিক্ত বাস্তব ঘটনা। এবং এক শেকড়হীন ভদ্রশ্রেণী কোন অবলম্বনই এখন
ধরে উঠতে পারেনি। আর অনেক মারত্মক ঘটনাই ঘটছে। তার মধ্যে আমার ব্যর্থতা অতি
তুচ্ছ একটি ঘটনা মাত্র।
আমি শুধু এইটুকু বলতে চাই যে, আমাদের
ঐতিহ্যের মধ্যে বিজ্ঞানের সাহায্য নিয়ে আমরা যদি আবার অনুপ্রবেশ না করি
তাহলে কোন জাতীয় শিল্পই গড়ে উঠতে পারবে না। ছবি তো নয়ই। কারণ, ছবি নিয়ে
ছেলেখেলা আর বোধহয় ঠিক হবে না। কারণ ছবির একটা বিরাট সৃষ্টিশীল ভূমিকা
এদেশে অচিরেই আসতে পারে।
উপরোক্ত ঘটনাটি সম্পর্কে তীব্রভাবে অবহিত আছি বলে আমার ছবি করার মধ্যে একটি ঝোঁক গোড়া থেকেই আছে।
ধরুন, অযান্ত্রিক। বিমল চরিত্রটি archetypal , বুলাকি পাগলা তার absurd
extension এবং নৃত্যপরায়ন আদিবাসী উরাওরা তার sublime extreme. পিয়ারা সিং
হচ্ছে tough minded as opposed to tender-mindedness of bimal. কাদা ছোঁড়া
বাচ্চার দল বিমলে আর একটা রূপক এবং সঙ্গে সঙ্গে কবি জীবনের নিষ্ঠুরতার
প্রতীক।
তাই তাদের সবার সিকোয়েন্সগুলি আমি বেশি বেশি করে রেখেছি। সমস্ত
নকশাটাকে গোটাভাবে ধরার জন্য। আদিবাসি গানগুলি হিসেব করে ব্যবহৃত, যদিও
তাদের মানে এখানে বোধগম্য হলো না। এইজন্য আমায় বহু গাল খেতে হয়েছে।
মেঘে ঢাকা তারা। উমার symbologyটা এখানে খুবই পরিষ্কার। নীতা আজ পর্যন্ত
আমার সৃষ্ট চরিত্রগুলোর মধ্যে আমার সবচেয়ে প্রিয়। আমি তাকে কল্পণা করেছি শত
শত বছরের বাঙালি ঘরের গৌরি দান দেওয়া মেয়ের প্রতীকরূপে। তার জন্মদিন হয়
জগদ্ধাত্রী পূজোতে। তার পাহাড় অর্থাৎ মহাকালের সঙ্গে মিলন হয় মৃত্যুতে। যখন
বিদায়ের প্রথম ইংগিত আসে যক্ষার প্রথম আভাসে তখন কারা যেন বিনিয়ে বিনিয়ে
মেনকার বিজয়ার প্রলাপ গাইতে থাকে। অবলুপ্তির আগের মুহুর্তের যে আরোকময়
পারিপার্শ্বিকতার স্বপ্ন দেখে নীতা- ছোটবেলায় পাহাড়ে চড়ে উঠে সূর্যোদয়
দেখার স্মৃতির মধ্য দিয়ে।
এবং বিবেকরূপী বংশী মুদি তাই বলে, শান্ত মেয়ে, ওর কি অতো চাপ সাজে?
কোমল গান্ধার। শকুন্তলা বাংলাদেশে পরিণত আমার কাছে। রবি ঠাকুরের সেই
আশ্চর্য সুন্দর প্রবন্ধটি-শকুন্তলা এবং মিরান্ডার অপূর্ব তুলনা যেখানে
রয়েছে, সেটি আমাকে প্রভাবিত করে। চারিপাশের যে দ্বিধা, যে ভাঙন, আমি জানি,
তার মূল হচ্ছে ভাঙা বাংলা। পূর্ব বাংলার লোক বলে একথা মনে করি না। গোটা
বাংলার ঐতিহ্যটা আয়ত্ব করার চেষ্টা করি বরেই একথা জানি যে, দুই বাংলার মিলন
অবশ্যম্ভাবী। তার রাজনৈতিক তাৎপর্য আমার কাছে হিসেব করার বিষয় নয়; কিন্তু
সাংস্কৃতিক মূল্য আমার কাছে অবধারিত।
তাই কোমলগান্ধারের মূল সুর হচ্ছে
মিলনের। স্তরের উপর স্তর দিয়ে, রূপকের উপর রূপক চাপিয়ে, বিদ্যুতের ঝিলিকের
মতো যদি কোথাও সেই জীবন সত্যটি ছুঁতে পারি, সে চেষ্টাই করেছিলাম।
সুবর্ণরেখা। আমাদের নায়িকা যখন ছোট্টটি, তখন সে একদিন সুবর্ণরেখা নদীর ধারে
ঘন শালবনের মধ্যে এক বিরাট ভাঙ্গা airport আবিষ্কার করে। ওর ভারি মজা
লাগে। ভাঙ্গা এরাপ্লেনগুলি দেখে ওর শোনা কথা মনে পড়ে যে, ঐগুলিতে চেপে
মার্কিন সাহেবরা রাত্রির বেলাতে উড়ে গিয়ে সেই কোথায় এক বর্মাদেশে, তার
ঘুমিয়ে থাকা শহরগুলির উপর বোমা ফেলে আসতো। আর এই যে নীরব ক্লাবঘর, এখানে কত
হৈ-চৈ না হতো, সাহেবগুলি বোমা ফেলে এসে এইখানে হৈ-হুল্লোর করতো।
ভারি খুশি হয়ে-যাওয়া মেয়েটি হাততালি দিয়ে নেচে নেচে সেই ফাটল ধরে যাওয়া সুবিশাল অ্যাসফল্টের শ্মসানের ওপরে বেড়াচ্ছিল।
হঠাৎ তার সামনে এসে দাঁড়ালো এক বীভৎস কালীমূর্তি। আঁতকে উঠে মেয়েটি আশ্রয়
নিলো পথচারী অপর এক চরিত্রের কোলে। তখন জানলো কালীমূর্তিওয়ালাটি আসলে এক
বহুরূপী, সে শুধু পেটের ভাতের পয়সার জন্য এই রকম সাজে। সে ছোট্ট দিদিমণিকে
ভয় দেখাতে চায়নি, শুধু সামনে পড়ে গেছে। আজ সব সভ্যতার জবিন-মরণ সমস্যা ঐ
confrontation-এর ওপরে।
এর বিশদ ব্যাখ্যা করা আমার পক্ষে অসম্ভব